অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর রাজ্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করল SIR বা ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা। অনেকেই এটা নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, রাজ্যের প্রতিটি পরিবারকে একটি একক সামাজিক পরিচয় নম্বর দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে সরকারি সুবিধাগুলিকে আরও স্বচ্ছ, সহজ ও দ্রুত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এখানে আবার চলছে নিবিড় সমীক্ষা। তবে ইতিমধ্যেই বিহারে প্রচুর মানুষের নাম বাদ পড়ে গিয়েছে তাই মানুষ চিন্তিত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কি মানুষের নাম বাদ পড়বে? রাজ্যজুড়ে সমীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে তাই যাদের সন্দেহ রয়েছে তারা অবশ্যই সমীক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য জেনে নিতে পারেন।

SIR প্রকল্প মূলত এমন একটি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে এক ছাতার নিচে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগীর তথ্য সংযুক্ত থাকবে। ফলে একদিকে যেমন প্রকল্পের অপব্যবহার বন্ধ হবে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষও সহজেই জানতে পারবেন তাঁরা কোন কোন সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন বা পাওয়ার যোগ্য।
কেন চালু হলো SIR প্রকল্প?
রাজ্য সরকারের এক শীর্ষকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দপ্তরের একাধিক প্রকল্পের তথ্য আলাদা আলাদা ডাটাবেসে থাকার কারণে অনেক সময় একই ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পে নাম তোলেন। আবার অনেকে প্রকৃত সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন তথ্যের অসামঞ্জস্যতার কারণে। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য রাজ্য জুড়ে চালু হচ্ছে SIR বা ভোটার তালিকা নিবিড় সমীক্ষা।
SIR চালুর ফলে—
- সব দপ্তরের তথ্য এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকবে।
- একজন ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পে নাম থাকলে তা সহজেই ধরা পড়বে।
- প্রকৃত সুবিধাভোগী বাছাই করা আরও সহজ হবে।
- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
- সরকারি তহবিলের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
কারা নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন?
SIR প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রত্যেক নাগরিক নিজ নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। তবে পরিবারের এক জনের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলেই পুরো পরিবারের তথ্য সংযুক্ত করা যাবে। ফলে ২০০২ সালের এই ভোটার তালিকায় যদি কারো একজনের নাম থেকে থাকে তাহলে পুরো পরিবার সুরক্ষিত থাকবে।
বিশেষ করে নিম্নলিখিত শ্রেণির মানুষদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—
- বেকার যুবক-যুবতী যারা সরকারি চাকরি বা প্রশিক্ষণ প্রকল্পে আবেদন করছেন।
- কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণি।
- বৃদ্ধ, বিধবা বা প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপকেরা।
- রাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা (যেমন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, খাদ্যসাথী, ছাত্র ঋণ প্রকল্প ইত্যাদি)।
SIR রেজিস্ট্রেশনে কী কী নথি লাগবে?
আবেদনকারীর পরিচয় ও ঠিকানার সত্যতা যাচাই করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নথি প্রয়োজন হবে। নিচে সেগুলি তালিকাভুক্ত করা হলোঃ
| নথির ধরন | প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস | মন্তব্য |
|---|---|---|
| পরিচয় প্রমাণ | আধার কার্ড / ভোটার আইডি / প্যান কার্ড | যেকোনো একটি বাধ্যতামূলক |
| ঠিকানা প্রমাণ | বিদ্যুৎ বিল / রেশন কার্ড / ব্যাংক পাসবুকের ঠিকানা | সর্বশেষ আপডেট থাকা জরুরি |
| জন্ম তারিখ প্রমাণ | জন্ম সনদ / মাধ্যমিক সনদ | ১৮ বছরের কম হলে অভিভাবকের নাম যুক্ত হবে |
| ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য | পাসবুকের প্রথম পৃষ্ঠার কপি | সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য |
| রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি | ২ কপি | অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে প্রয়োজন |
আবেদন করার পদ্ধতি (অনলাইন ও অফলাইন)
যদি কোন ব্যক্তির নাম বাদ পড়ে যায় তাহলে তাকে নতুন করে আবার আবেদন জানাতে হবে। এক্ষেত্রে আবেদন জানানোর জন্য নিচের পদ্ধতি অবলম্বন করে অনলাইন এর মাধ্যমে বা অফলাইনের মাধ্যমে আবেদন জানাতে পারবেন।
অনলাইন পদ্ধতি:
- প্রথমে সরকারি SIR পোর্টালে যান (অফিসিয়াল লিংক পরে প্রকাশ করা হবে)।
- “New Registration” অপশনে ক্লিক করুন।
- আপনার নাম, মোবাইল নম্বর ও ইমেল আইডি দিন।
- OTP ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করুন।
- প্রয়োজনীয় নথিগুলি আপলোড করুন।
- আবেদন জমা দেওয়ার পর একটি ইউনিক রেজিস্ট্রেশন আইডি পাওয়া যাবে।
অফলাইন পদ্ধতি:
- স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস / পৌরসভা / ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকে আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করুন।
- ফর্ম পূরণ করে প্রয়োজনীয় নথি সংযুক্ত করুন।
- সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিন এবং রসিদ সংরক্ষণ করুন।
আবেদন জমার শেষ তারিখ
সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে আবেদন গ্রহণ চলবে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে তথ্য যাচাই ও নাম তালিকা প্রকাশ করা হবে ২০২৬ সালের শুরুতে।
কারা বাদ পড়তে পারেন তালিকা থেকে?
প্রকল্পের উদ্দেশ্যই হলো প্রকৃত সুবিধাভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা। তাই যাদের তথ্য মিলছে না বা যারা একাধিক প্রকল্পে ভুয়া নামে সুবিধা নিয়েছেন, তাঁদের নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ পড়বে।
নিচের ক্ষেত্রে নাম বাতিল হতে পারে:
- ভুয়া বা ভুল তথ্য দিলে।
- একই ব্যক্তি একাধিক পরিবারের সদস্য হিসেবে নাম তুললে।
- মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির নাম আপডেট না করলে।
- অন্য রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে।
যাচাই ও আপডেট প্রক্রিয়া
SIR প্রকল্পে তথ্য আপডেট করার সুযোগ থাকবে। যদি কেউ বিবাহ, মৃত্যু, ঠিকানা পরিবর্তন বা অন্য কোনো কারণে তথ্য বদল করতে চান, তাহলে অনলাইন পোর্টাল থেকেই তা আপডেট করা যাবে।
যাচাই প্রক্রিয়া চলাকালীন ব্লক লেভেল অফিসাররা সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য মিলিয়ে দেখবেন।
প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য
SIR প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো—
- রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে একটি একক সামাজিক পরিচয় নম্বর (Unique Social ID) দেওয়া।
- সরকারি সুবিধা পেতে বারবার আলাদা ফর্ম না ভরতে হওয়া।
- ডিজিটাল প্রশাসনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বাড়ানো।
- প্রতারণা ও পুনরাবৃত্তি রোধ করা।
SIR প্রকল্পের সুবিধা এক নজরে
| সুবিধা | ব্যাখ্যা |
|---|---|
| একক নম্বরের মাধ্যমে সব প্রকল্পে যোগসূত্র | আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন হবে না |
| সরকারি তথ্য যাচাই সহজ হবে | স্বয়ংক্রিয় ডাটাবেস মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব |
| অপব্যবহার বন্ধ | ভুয়া নাম বা দ্বৈত সুবিধা প্রতিরোধ হবে |
| প্রকৃত সুবিধাভোগী শনাক্ত | যারা সত্যিই প্রয়োজনীয়, তারাই পাবেন সহায়তা |
| অনলাইন আপডেট ব্যবস্থা | ঠিকানা বা তথ্য বদল সহজেই করা যাবে |
| স্বচ্ছ প্রশাসন | সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে |
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, “এই প্রকল্পের ফলে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা আরও বাড়বে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।”
অন্যদিকে কিছু মানুষ মনে করছেন, যদি আবেদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল হয়, তবে যাদের স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট নেই, তাঁদের জন্য আলাদা সহায়তা কেন্দ্র খোলা উচিত।
সরকারের পরবর্তী পরিকল্পনা
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, SIR প্রকল্পের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে ভবিষ্যতে “Smart Citizen Database” গঠন করা হবে। এতে নাগরিকদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আয়, স্বাস্থ্য ইত্যাদি তথ্য সংরক্ষিত থাকবে, যা উন্নয়ন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
এই উদ্যোগ সফল হলে রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের কাছে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে যাবে আরও দ্রুত, সহজ ও নির্ভুলভাবে। এখন দেখার পালা, কতটা দক্ষভাবে প্রশাসন এই বিশাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারে এবং জনগণ কতটা উপকৃত হন তার ফলশ্রুতি কেমন দাঁড়ায়।
রাজ্যে এখন এক নতুন উদ্যোগের সূচনা — SIR বা ভোটার তালিকা সমীক্ষা। এর মাধ্যমে অবৈধভাবে যারা ভারতে বসবাস করছে বা অবৈধভাবে যারা ভোটার কার্ড বানিয়েছে তাদের নাম বাতিল চলে যেতে পারে। এর ফলে যারা প্রকৃত ভারতীয় তাদের নাম সুরক্ষিত থাকবে এবং তারা সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তাই দেরি না করে নিজের ও পরিবারের নাম রেজিস্ট্রেশন করান, যাতে কোনো সরকারি সুবিধা থেকে আপনি বাদ না পড়েন।
